ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এটি বাংলাভাষীদের তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য পরিচালিত আন্দোলন, যা ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তীব্র রূপ ধারণ করে এবং এর ফলে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার জন্যই ছিল না, এটি পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।
পটভূমি
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্তি ঘটে, যার ফলে পাকিস্তান দুটি অংশে বিভক্ত হয়: পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান)। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকাংশই ছিল বাংলাভাষী, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের ভাষা, উর্দুকে সারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ও ভাষা:
- পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৫৬% মানুষ বাংলাভাষী ছিল।
- পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, যা বাংলাভাষীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার কারণ:
- পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দু ভাষাকে একক রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে ছিল, কারণ তারা মনে করেছিল এটি মুসলমানদের ঐক্যকে প্রতিফলিত করবে এবং দেশকে সংহত রাখবে।
- পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের দাবিকে উপেক্ষা করে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
ঘটনা প্রবাহ
১. ১৯৪৮ সাল
- ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এক বক্তৃতায় ঘোষণা করেন যে, "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।"
- এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করে।
২. ১৯৫২ সাল
- ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন চরমে পৌঁছে। পূর্ব পাকিস্তানের সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।
- এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাধারণ জনগণ মিলে মিছিল বের করলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়।
- পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ অনেক ছাত্র শহীদ হন। এই দিনটি ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ওঠে।
৩. ১৯৫৬ সাল
- ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে এ আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা ও স্বাধিকার অর্জনের ভিত্তি তৈরি করে।
প্রভাব
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান
ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটায়। বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করছে। এর ফলশ্রুতিতে বাঙালিদের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের চেতনা গড়ে ওঠে।
২. স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি
ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি। ভাষার জন্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা উপলব্ধি করতে পারে যে, তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারও পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা উপেক্ষিত হচ্ছে। এটি পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়।
৩. সাংস্কৃতিক জাগরণ
ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের মধ্যে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরিচয় সম্পর্কে নতুন করে চেতনা জাগিয়ে তোলে। ভাষার প্রতি এই আবেগ এবং শ্রদ্ধা থেকে বাঙালি সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং শিল্পকলা নতুনভাবে বিকাশ লাভ করে।
৪. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এটি ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, যা বিশ্বের সব মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আহ্বান জানায়।
উপসংহার
ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার অধিকারের জন্য নয়, এটি বাঙালির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অধিকার রক্ষার আন্দোলন হিসেবে বিবেচিত হয়। ভাষার জন্য এই আত্মত্যাগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে।
0 Comments