একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অর্থনৈতিক সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থনৈতিক সম্পদ মূলত: (১) প্রাকৃতিক, (২) মানবিক ও (৩) মূলধনী− এই তিন ধরণের হয়ে থাকে। এই পাঠে আমরা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অর্থনৈতিক সম্পদ নিয়ে আলোচনা করবো। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পদ বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যারা প্রাকৃতিক অর্থনৈতিক সম্পদের উপর অধিক নির্ভরশীল। বাংলাদেশেও প্রকৃতিগতভাবে কিছু অর্থনৈতিক সম্পদ আছে সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলোঃ
ক. কৃষি সম্পদ
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো প্রধানত কৃষিভিত্তিক এবং এ দেশের ভূমি কৃষির জন্য খুবই উর্বর। এ দেশে ২২ মিলিয়ন একর কৃষি জমি রয়েছে। দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। শিল্পক্ষেত্রে ইহা কাঁচামাল ও শ্রমিক সরবরাহ করে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, মেশিন, জ্বালানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা হয় কৃষিজ দ্রব্য রপ্তানি করার মাধ্যমে। এ দেশের কৃষিক্ষেত্রে ধান, গম, পাট, ডাল, আলু, চা, তামাক, আলু, তৈলবীজ, রেশম প্রভৃতি কৃষিজ ফসল উৎপন্ন হয়।
খ. খনিজ সম্পদ
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খনিজ দ্রব্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ দিক দিয়ে বাংলাদেশ খুব একটা সমৃদ্ধ নয়। তবে বর্তমানে বিভিন্ন ভৌগোলিক জরিপের মাধ্যমে এ দেশে বিভিন্ন খনিজ দ্রব্যের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এ দেশের প্রধান প্রধান খনিজ সম্পদের বিবরণ নিচে দেয়া হলো:
১. প্রাকৃতিক গ্যাস: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুলাংশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। এ পর্যন্ত ২৪টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান গ্যাসক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- তিতাস, বিয়ানীবাজার, জালালাবাদ, কৈলাসটিলা ও ছাতক। ২২টি গ্যাসক্ষেত্রে মোট মজুদের পরিমাণ ২৮.৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহৃত হয়। সার কারখানায় কাঁচামালের এবং বাণিজ্যিক, কলকারখানা ও গৃহস্থালী খাতে জ্বালানির প্রধান উৎস গ্যাস।
২. কয়লা: বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার বড় পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী ও দিঘীপাড়া, রংপুর জেলার খালাশপীর ও জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জে কয়লা, সিলেট ও রাজশাহীতে কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে। কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৩. চুনাপাথর: সুনামগঞ্জ জেলার টেকেরহাট, লালঘাট, ভাঙ্গারহাট, জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড ও সেন্টমার্টিন দ্বীপে চুনাপাথরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সিমেন্ট, গ্লাস, কাগজ, সাবান, ব্লিচিং পাউডার প্রভৃতি উৎপাদনে এবং গৃহ নির্মাণে চুনাপাথর ব্যবহৃত হয়।
৪. চীনামাটি: চীনামাটি প্রধানত: টাইলস, সিরামিকের জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ময়মনসিংহ জেলার বিজয়পুর এবং নওগাঁ জেলার পত্নীতলায় চীনামাটির খনি রয়েছে।
৫. সিলিকা বালু: এটি প্রধানত: কাঁচ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, জামালপুর ও কুমিল্লা জেলায় সিলিকা বালু পাওয়া যায়।
৬. খনিজ তেল: বাংলাদেশে এখনও উল্লেখযোগ্য খনিজ তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়নি। সিলেটের হরিপুরে খনিজ তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাছাড়া, দেশের উপকূলীয় এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রামে খনিজ তেল সঞ্চিত আছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
৭। কঠিন শিলা: রংপুরের রানীপুকুর ও দিনাজপুরের মধ্যপাড়ার কঠিন শিলার মজুদ রয়েছে। রেললাইন, বাঁধ নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরি ইত্যাদি কাজে কঠিন শিলার প্রয়োজন হয়।
৮। তামা: রংপুর জেলার রানীপুকুর ও দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়ায় কঠিন শিলাস্তরে তামার সন্ধান পাওয়া গেছে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, মুদ্রা, বাসন-কোসন ইত্যাদি তৈরিতে তামার প্রয়োজন।
গ. বনজ সম্পদ
একটি দেশের বনভূমি ও বনজ সম্পদ সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটি দেশের মোট ভূমির ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বনভূমি মোট ভূমির ১৭ ভাগ যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ দেশের বনভূমি অঞ্চলকে প্রধানত: ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।
(১) সুন্দরবন: বাংলাদেশের প্রধান বনভূমি সুন্দরবন। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলার সমুদ্র উপকূলে এ বন অবস্থিত। এর আয়তন ৬,০০০ বর্গকিলোমিটার। এই বনাঞ্চলকে ম্যানগ্রোভ বনভূমি বলা হয়। এ বনভূমিতে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, বাইন প্রভৃতি মূল্যবান গাছ জন্মে। তাছাড়াও গোলপাতা, মধু, মোম, কাঁকড়া ইত্যাদি এ বন থেকে আহরণ করা হয়। এ বনভূমিতে বাঘ, কুমির, হরিণ প্রভৃতি মূল্যবান জীবজন্তু এবং অসংখ্য প্রজাতির পাখি রয়েছে।
(২) চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ী বনভূমি: চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ক·বাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ এর বনভূমি পাহাড়ী বনভ‚মির অন্তর্গত। এ অঞ্চলের বনভূমিকে চিরসবুজ বনভূমিও বলা হয়। এ বনভূমিতে সেগুন, গর্জন, গামারি, চাপালিশ, জারুল, বাঁশ, বেত, শিমুল প্রভৃতি গাছ বিপুল পরিমাণে জন্মায়। এ বনভূমিতে রয়েছে হাতি, হরিণ এবং অসংখ্য প্রজাতির পাখি।
(৩) শাল ও ভাওয়াল বনভূমি: প্রধানত: গাজীপুর জেলার ভাওয়াল গড়, টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর গড়, শেরপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা জেলায় এ ধরণের বনভূমি রয়েছে। তাছাড়াও দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের দিনাজপুর, রংপুর, ঠাকুরগাঁও ও নওগাঁতে এ ধরনের বনভূমির অস্তিত্ব রয়েছে। এ বনভূমির মোট আয়তন ১২০০ বর্গকিলোমিটার। এ বনভূমিতে শাল, গজারি ও কড়ই গাছ জন্মায়।
পানি সম্পদ
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে পানি সম্পদ অন্যতম। দেশের অর্থনীতি পানি সম্পদের উপর নির্ভরশীল। কৃষিজ, বনজ ও মৎস্য সম্পদ এ পানি সম্পদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বিভিন্ন নদ-নদী এ দেশের পানি সরবরাহের প্রধান উৎস। বঙ্গোপসাগর হচ্ছে এ দেশে ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহের একটি প্রধান উৎস। তাছাড়া, বৃষ্টির পানি ও ভূগর্ভস্থ পানি এ দেশের পানির চাহিদা অনেকটা পূরণ করে।
মৎস্য সম্পদ
মাছ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পদ। এ দেশের ১২ লাখ লোক প্রত্যক্ষভাবে মৎস্য খাতে নিয়োজিত আছে। মৎস্য সম্পদ এ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ৪.৭ ভাগ, রপ্তানি আয়ে ৯.১ ভাগ এবং প্রাণীজ প্রোটিনের ৮০ ভাগ পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া, বিভিন্ন কুটির শিল্প এবং হাঁস-মুরগীর খামারে মাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়।
শক্তি সম্পদ
একটি দেশের কৃষি ও শিল্পকারখানা ভিত্তিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি হচ্ছে শক্তি সম্পদ। বিভিন্ন উৎস হতে শক্তি পাওয়া যায়। শক্তির উৎসগুলো হচ্ছে বায়ু, পানি ও বিদ্যুৎ। আবার, বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদিত হয় কয়লা, গ্যাস, খনিজ তেল, সৌরশক্তি ও আণবিক শক্তি থেকে। বাংলাদেশ কয়লা ও খনিজ তেলের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনে খুব সমৃদ্ধ নয়। তবে পানি সম্পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে দেশে সৌরশক্তির উৎপাদন কিছুটা শুরু হয়েছে। তাছাড়া জৈব আবর্জনা যেমন-মৃত গাছপালা ও প্রাণী, গো-সার থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা হয়। এ বায়োগ্যাসের মাধ্যমে দেশে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ৮৯% শক্তির উৎস হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস। বাকিটুকু উৎপাদিত হয় জ্বালানি তেল, কয়লা ও পানি থেকে। পানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎকে পানি বিদ্যুৎ বলে। রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই নামক স্থানে কর্ণফুলি নদীর তীরে দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবস্থিত। গ্যাস, কয়লা, তেলের উৎপাদিত বিদ্যুৎকে তাপ বিদ্যুৎ বলে। এ দেশে খনিজ তেল দ্বারা চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হচ্ছে:
১। ভেড়ামারা তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কুষ্টিয়া
২। ঠাকুরগাঁও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র
৩। সৈয়দপুর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নীলফামারী
৪। গোয়ালপাড়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, খুলনা
এবং গ্যাস দ্বারা চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হচ্ছে:
১। আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
২। ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নরসিংদী
৩। সিদ্ধিরগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জ
৪। শাহজিবাজার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিলেট
৫। চট্টগ্রাম তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
পারমাণবিক শক্তি সম্পদ
বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায় রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক শক্তি প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে এই পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পটি স্থাপিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ প্রকল্পটির দু’টি ইউনিটের শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা ২,৪০০ মেগাওয়াট এবং বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ২.৪ গিগাওয়াট (উৎস: উইকিপিডিয়া)। ২০২৩ সালে এই প্রকল্পটির উৎপাদন কাজ শুরু হবে।
0 Comments