Recent Posts

সামরিক শাসন ও আইয়ুবীয় স্বৈরাচার



সামরিক শাসন ও আইয়ুবীয় স্বৈরাচার পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়, যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের জন্য আরও বেশি শোষণ ও অবিচারের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন আরোপ করে জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন, এবং প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি পাকিস্তানের শাসন করেন। তার শাসনামল পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য কিছু উন্নয়নের সূচনা করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য তা ছিল শোষণ, বৈষম্য এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের যুগ।


সামরিক শাসন আরম্ভ: ১৯৫৮ সালের অভ্যুত্থান


১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে তিনি রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করেন এবং নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন।


সামরিক শাসনের কারণ:

- পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধের কারণে দেশজুড়ে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

- পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য বারবার আন্দোলন শুরু করছিল, যা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

- সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে জেনারেল আইয়ুব খান এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সামরিক শাসন জারি করেন এবং একটি একনায়কতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন।


আইয়ুব খানের শাসনামল (১৯৫৮-১৯৬৯)


১. সংবিধান বাতিল ও নতুন সংবিধান প্রণয়ন

- আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করেন এবং ১৯৬২ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন।

- এই সংবিধানে প্রেসিডেন্টের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা হয় এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য আরও দৃশ্যমান হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকারগুলো এই সংবিধানে অবহেলিত থাকে।

  

২. মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা

- আইয়ুব খান নতুন শাসন ব্যবস্থা চালু করেন, যা মৌলিক গণতন্ত্র নামে পরিচিত। এটি ছিল কার্যত একনায়কতান্ত্রিক শাসনের আড়ালে গণতন্ত্রের মোড়কে লুকানো একটি ব্যবস্থা।

- নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরাসরি জনগণের ভোটে নয়, বরং স্থানীয় প্রতিনিধি দ্বারা নির্বাচিত হতেন। এতে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার হ্রাস পায় এবং একনায়কতন্ত্রের ধাঁচে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।


৩. পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য

- আইয়ুব খানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার অবহেলা করে এবং বৈষম্য আরও গভীর করে।

  

- পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করা হয়, যার ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এবং পূর্ব বাংলার মানুষ ক্রমশ হতাশায় নিমজ্জিত হয়।


৪. ভাষা ও সংস্কৃতি দমন

- পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আইয়ুব সরকারের অবজ্ঞা ও শোষণ আরও বৃদ্ধি পায়। ভাষা আন্দোলনের পরও পূর্ব বাংলার জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার পুরোপুরি স্বীকৃতি পায়নি।

  

- আইয়ুব খানের আমলে পূর্ব বাংলার জনগণের ভাষা, সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, বরং পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু সংস্কৃতিকে আধিপত্যবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়।


৫. বিরোধী দলের দমন

- আইয়ুব খান সরকার তার বিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করে। পূর্ব পাকিস্তানের অনেক নেতাকর্মী, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতাদের গ্রেফতার এবং রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়।  


৬. শিক্ষা কমিশন ও বাঙালিদের প্রতিক্রিয়া

- ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান শরীফ শিক্ষা কমিশন গঠন করেন, যা শিক্ষার মান উন্নয়নের পরিবর্তে এর বাণিজ্যিকীকরণ এবং শিক্ষাকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার শিক্ষার্থীরা প্রবল ক্ষুব্ধ হয় এবং আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন বাঙালিদের মধ্যে নতুন করে স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তোলে।


আইয়ুববিরোধী আন্দোলন


১. ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন

- শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল। ছয় দফার মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সুরক্ষা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হ্রাস করা।

- এই ছয় দফা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে বাঙালিদের মধ্যে নতুন করে প্রতিরোধের জাগরণ তৈরি হয়।


২. আইয়ুব খানের পতন (১৯৬৯)

- ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে ব্যাপক জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে দেশজুড়ে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে।

- অবশেষে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন করে ক্ষমতা দখল করেন।


সামরিক শাসনের প্রভাব


১. বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতার চেতনার উত্থান

আইয়ুব খানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অধীনে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক অধিকার পূর্ণভাবে রক্ষা করা সম্ভব নয়। এর ফলে বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা আরও জোরালো হয় এবং ক্রমশ স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়।


২. রাজনৈতিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে লড়াই

আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর প্রতিরোধের জন্ম দেয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিরা ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্তির জন্য সংগঠিত হতে থাকে।


৩. অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি

আইয়ুব খানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ ব্যবহার করা হলেও পূর্ব বাংলার জন্য তেমন কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। এতে করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য আরও গভীর হয়।


৪. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি

আইয়ুব খানের শাসনের অবসানের পরও সামরিক শাসন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুক্তি পায়নি। তবে এই শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বাঙালিরা পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য নিজেদের সংগঠিত করে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে।


উপসংহার


আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য এক দুঃসহ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তার শাসনামলে পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক অধিকার বারবার অবহেলিত হয়েছে। এই শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধই পরবর্তীতে স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে, যা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে।

Post a Comment

0 Comments