Recent Posts

ব্রিটিশ শাসনের অবসান


ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান একটি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক সংগ্রামের ফলাফল, যা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয় ১৮৫৮ সালে, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন সরিয়ে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ভারত আসে। তবে ২০০ বছরের এই ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পেছনে অনেকগুলো কারণ ও আন্দোলন কাজ করেছিল।


ব্রিটিশ শাসনের অবসানের প্রধান কারণগুলো:


১. ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ শাসনের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ থেকে শুরু করে, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, ভগত সিংসহ অন্যান্য নেতাদের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে।


- মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন (1920-1922), সিভিল নাফরমানি আন্দোলন (1930) এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলন (1942) ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন।

  

- বিপ্লবী আন্দোলনও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রাম করে। ভগত সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, সূর্য সেন প্রমুখ বিপ্লবীরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।


২. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (1939-1945) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শক্তি এবং অর্থনৈতিক অবস্থাকে অনেকটাই দুর্বল করে ফেলে। যুদ্ধে ভারতের বিপুল সম্পদ ও সৈন্য ব্যবহার করা হয়, কিন্তু যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশরা অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। এতে ভারতের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা ব্রিটিশদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া, যুদ্ধকালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, যা ব্রিটিশদের প্রতি ভারতীয় জনসাধারণের অসন্তোষকে বাড়িয়ে তোলে।


৩. ভারত ছাড়ো আন্দোলন (1942)

মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯৪২ সালে শুরু হওয়া ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ ছিল। এই আন্দোলনে ভারতজুড়ে ব্যাপক গণ-অসন্তোষ এবং আন্দোলন গড়ে ওঠে। যদিও আন্দোলনটি দমন করা হয়, তবু এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা দেয় এবং ব্রিটিশরা বুঝতে পারে, তারা আর বেশিদিন ভারত শাসন করতে পারবে না।


৪. নৌবিদ্রোহ (1946)

১৯৪৬ সালের বোম্বে নৌবিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর বিদ্রোহের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এতে ভারতীয় নাবিকরা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং দ্রুতই এই বিদ্রোহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহ ব্রিটিশদের বোঝায় যে, ভারতের সশস্ত্র বাহিনীও তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই এবং শাসন দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব নয়।


৫. ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে মুসলিম লীগ একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জানায়। ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে ভারতের শাসনকে বজায় রাখার চেষ্টা করলেও, শেষ পর্যন্ত এটি আরো বাড়তে থাকে এবং ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র (ভারত ও পাকিস্তান) গঠিত হয়।


৬. ব্রিটিশ জনমতের পরিবর্তন

ব্রিটিশদের মধ্যেও ভারতের শাসন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ জনমনে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি হয়। ব্রিটিশ অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তারা বুঝতে পারে, ভারতের মতো বিশাল একটি দেশকে ধরে রাখা আর সম্ভব হবে না।


৭. লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা

১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন আসেন। তিনি ব্রিটিশ শাসনের দ্রুত সমাপ্তির পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজন এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন।


ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি এবং ভারতের স্বাধীনতা

- ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে এবং একই বছরের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান গঠিত হয়।

- ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন জওহরলাল নেহরু, এবং মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে স্বাধীনতা অর্জনে।

 


উপসংহার

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ছিল বহু বছরের সংগ্রামের ফল। অহিংস আন্দোলন, সশস্ত্র প্রতিরোধ, ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা, এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন সব মিলিয়ে ব্রিটিশদের বাধ্য করে ভারত ত্যাগ করতে। ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং এর প্রভাব শুধু ভারতেই নয়, অন্যান্য উপনিবেশিক দেশগুলোর স্বাধীনতা আন্দোলনকেও অনুপ্রাণিত করেছিল।

Post a Comment

0 Comments