ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত ছিল এবং একই লক্ষ্যে অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পরিচালিত হয়েছিল। প্রতিটি আন্দোলনই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তবে তাদের কৌশল ও দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা ছিল।
১. খিলাফত আন্দোলন (1919-1924)
খিলাফত আন্দোলন ছিল মূলত মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার ও খেলাফতের (Ottoman Caliphate) প্রতি আনুগত্য রক্ষার আন্দোলন। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয়, যখন ওসমানীয় সাম্রাজ্য পরাজিত হয় এবং ব্রিটিশরা তুরস্কের খলিফার ক্ষমতা সীমিত করতে চায়। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে খলিফার প্রতি গভীর আনুগত্য ছিল, যাকে তাঁরা ইসলাম ধর্মের নেতা হিসেবে মানতেন।
খিলাফত আন্দোলনের কারণ:
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ও তুরস্কের খলিফার ক্ষমতা হ্রাস মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
- ব্রিটিশদের এই নীতি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং তারা খলিফার সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।
খিলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব:
- মুহাম্মদ আলী এবং শওকত আলী নামক দুই ভাই এই আন্দোলনের মূল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এছাড়া মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং মাহাত্মা গান্ধীও এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন।
খিলাফত আন্দোলনের প্রভাব:
- খিলাফত আন্দোলন ভারতীয় মুসলমানদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে। এটি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরি করে।
- খিলাফত আন্দোলনের সাথে অসহযোগ আন্দোলন সংযুক্ত হয়, যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি মাইলফলক হয়ে ওঠে।
---
২. অসহযোগ আন্দোলন (1920-1922)
অসহযোগ আন্দোলন ছিল মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত একটি অহিংস আন্দোলন, যার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সকল প্রকার সহযোগিতা বন্ধ করা। এটি ছিল খিলাফত আন্দোলনের সময়েরই একটি অংশ এবং এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনসাধারণের সম্মিলিত প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান ধাপ।
অসহযোগ আন্দোলনের কারণ:
- 1919 সালের রাউলাট আইন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ছিল এই আন্দোলনের প্রধান কারণ। ব্রিটিশ সরকার ভারতের জনগণের ওপর দমননীতি গ্রহণ করে এবং ভারতের মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়।
অসহযোগ আন্দোলনের কৌশল:
- ব্রিটিশ পণ্য বর্জন: ভারতীয়রা ব্রিটিশ পণ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালত, এবং সরকারি চাকরি বর্জন করে।
- স্বদেশী শিল্পের প্রচার: গান্ধী স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁতের কাপড় এবং দেশীয় পণ্য ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেন।
- শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও সভা: অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এবং অসহযোগিতা।
অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব:
- প্রথমবারের মতো ভারতীয় জনসাধারণের একটি বড় অংশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়।
- আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রশাসন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- 1922 সালে চৌরি চৌরার একটি হিংসাত্মক ঘটনার পর গান্ধী এই আন্দোলন স্থগিত করেন। তবে, এটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে।
---
৩. সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন
অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি কিছু বিপ্লবী গোষ্ঠী সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, শুধু সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই ব্রিটিশদের ভারত থেকে উৎখাত করা সম্ভব।
সশস্ত্র আন্দোলনের প্রধান নেতারা:
- শহীদ ভগত সিং: ভগত সিং ছিলেন ভারতীয় বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা। তিনি ও তাঁর দল হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (HSRA) ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেন।
- চন্দ্রশেখর আজাদ: চন্দ্রশেখর আজাদ ছিলেন ভগত সিংয়ের সহযোদ্ধা এবং ভারতীয় বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম শক্তিশালী নেতা। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
- মাস্টারদা সূর্য সেন: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের (1930) নেতৃত্ব দেন। এটি ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অন্যতম বড় সশস্ত্র আক্রমণ।
সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের কৌশল:
- ব্রিটিশ সরকারি সম্পত্তি লুণ্ঠন, অস্ত্রাগারে হামলা, এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের ওপর আক্রমণ।
- বোমা হামলা এবং গুপ্তহত্যার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিরোধ।
সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রভাব:
- যদিও সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন সরাসরি ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করতে পারেনি, এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক ধরনের মানসিক চাপে রেখেছিল।
- এই আন্দোলন ভারতের যুবসমাজকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রভাবিত করে।
---
উপসংহার
খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন—তিনটি আন্দোলনই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের বিভিন্ন প্রতিরোধ কৌশলকে প্রতিফলিত করে। একদিকে গান্ধীজির নেতৃত্বে অহিংস আন্দোলন, অন্যদিকে বিপ্লবীদের সশস্ত্র প্রতিরোধ একই লক্ষ্যে, অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটাতে কাজ করেছিল।
0 Comments