Recent Posts

আগরতলা মামলা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান



আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৮ সালে এই মামলা দায়ের করা হয়, যা মূলত পাকিস্তান সরকার কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য বাঙালি নেতাদের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক মামলা ছিল। মামলার মাধ্যমে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল, তবে এর ফল হয় উল্টো। এই মামলা বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।


আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পটভূমি


১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের একটি সুস্পষ্ট দাবি ছিল। ছয় দফার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বাঙালিরা স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হতে শুরু করে। এই আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে শঙ্কিত করে তোলে। তাদের মতে, ছয় দফা ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতা নষ্ট করার একটি ষড়যন্ত্র। এর প্রেক্ষিতে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য বাঙালি নেতাদের স্বাধীনতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করে।


আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ঘটনা


আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল পাকিস্তানি শাসকদের একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মাধ্যমে তারা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য বাঙালি নেতাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিচারের মুখোমুখি করে। মামলার মূল অভিযোগ ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সঙ্গীরা ভারতের আগরতলা শহরে বসে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্য ষড়যন্ত্র করছিলেন। মামলায় মোট ৩৫ জন বাঙালি নেতাকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারাও ছিলেন।


মামলার মূল অভিযোগ:

- অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগীরা ভারতের আগরতলায় বসে ভারতের সরকারের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন।

- এই অভিযোগের ভিত্তিতে শেখ মুজিবসহ অন্যান্যদের পাকিস্তানের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়।


বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার ও বিচার


১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি করা হয়। শেখ মুজিবসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক আদালতে বিচার শুরু হয়। পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী মামলাটিকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল, যাতে বাঙালিদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যায়।


বাঙালির প্রতিক্রিয়া


আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাঙালি জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারা বুঝতে পারে যে, এটি শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য নেতাদেরকে পরিকল্পিতভাবে দমন করার একটি ষড়যন্ত্র। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাদের আস্থা বৃদ্ধি পায়।


১. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান

মামলার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ চরমে পৌঁছায়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, ছাত্র, শ্রমিক, এবং সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে এসে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি জানান।


২. গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদ ও অন্যান্যদের আত্মত্যাগ

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হন, যা পূর্ব পাকিস্তানে গণ-অভ্যুত্থানের আগুন আরও জ্বালিয়ে দেয়। এই আত্মত্যাগ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আরও উজ্জীবিত করে এবং ছাত্র সমাজ সহ অন্যান্যরা ব্যাপকভাবে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে।


আগরতলা মামলার প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি


গণ-অভ্যুত্থানের চাপে পড়ে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। একই দিন শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য আসামিদের মুক্তি দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে এবং তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।


আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রভাব


১. শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। মামলার পর তিনি শুধু আওয়ামী লীগের নেতা নয়, বরং সমগ্র বাঙালি জাতির স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন। তিনি গণমানুষের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন।


২. বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান

এই মামলা এবং এর বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধ জাতীয়তাবাদী চেতনার আরও বিস্তৃতি ঘটায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাঙালিরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার অধীনে তাদের মুক্তি সম্ভব নয়। এর ফলে স্বাধীনতার আন্দোলন আরও গতিশীল হয় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।


৩. সামরিক শাসনের অবসান ও গণতন্ত্রের দাবি

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। পাকিস্তানের সামরিক শাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের দাবি আরও দৃঢ় হয়।


উপসংহার


আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা একটি ষড়যন্ত্র ছিল, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু মামলাটি উল্টো বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে আরও শক্তিশালী করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই মামলার ফলস্বরূপ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিকে বাঙালির অগ্রযাত্রা আরও সুগঠিত ও সুসংহত হয়।

Post a Comment

0 Comments