Recent Posts

সিন্ধু সভ্যতা


সিন্ধু সভ্যতা

সিন্ধু সভ্যতা (Indus Valley Civilization) ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং সমৃদ্ধতম সভ্যতাগুলোর একটি, যা খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে ১৩০০ সালের মধ্যে বর্তমান পাকিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় গড়ে উঠেছিল। এটি হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত, কারণ হরপ্পা শহর এই সভ্যতার প্রথম আবিষ্কৃত নগর। 


সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্যসমূহ


1. ভৌগোলিক অবস্থান: সিন্ধু সভ্যতা সিন্ধু নদী এবং তার শাখাগুলির তীরে গড়ে উঠেছিল। এই নদীগুলো সভ্যতার কৃষি এবং পানির উৎস ছিল। সভ্যতাটি মূলত বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু, এবং ভারতের গুজরাট, রাজস্থান, এবং হরিয়ানার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছিল।


2. শহর পরিকল্পনা: সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের নগর পরিকল্পনা। শহরগুলো অত্যন্ত সুসংগঠিতভাবে তৈরি করা হয়েছিল। রাস্তাগুলো ছিল গ্রিড পদ্ধতিতে, এবং প্রতিটি শহরে পানির নিষ্কাশনের উন্নত ব্যবস্থা ছিল। বাড়িগুলো ইটের তৈরি ছিল, এবং প্রতিটি বাড়িতে পানির জন্য কুয়া এবং শৌচাগার ছিল।


3. বৃহৎ শহরগুলো: হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো ছিল সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শহর। মহেঞ্জোদারো শহরে গ্রেট বাথ নামক একটি বৃহৎ জলাধার ছিল, যা ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়। এছাড়াও, লোথাল, ধোলাভিরা, এবং কালিবঙ্গানও ছিল গুরুত্বপূর্ণ শহর।


4. অর্থনীতি: সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর ছিল। তারা গম, যব, তুলা এবং বিভিন্ন শস্য উৎপাদন করত। এছাড়াও, তারা পশুপালন এবং মাছ ধরা নিয়েও ব্যস্ত ছিল। সিন্ধু সভ্যতা ছিল একসময়ের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র; মেসোপটেমিয়া এবং অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।


5. শিল্প ও কারুশিল্প: সিন্ধু সভ্যতার মানুষ দক্ষ কারুশিল্পী ছিল। তারা তামা, ব্রোঞ্জ, এবং পাথর দিয়ে বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরি করত। মাটির পাত্র, খেলনা, অলংকার, সিলমোহর এবং মূর্তি নির্মাণে তারা পারদর্শী ছিল। বিশেষত, বিভিন্ন পশুপাখির চিত্রাঙ্কিত সিলমোহরগুলি তাদের শিল্পকলার অন্যতম দৃষ্টান্ত।


6. লিপি: সিন্ধু সভ্যতার মানুষ একটি চিত্রলিপি বা প্রতীকী লিপি ব্যবহার করত, যা এখনো সম্পূর্ণরূপে উদ্ধার বা বোঝা সম্ভব হয়নি। এই লিপির অনেক নমুনা সিলমোহরে পাওয়া গেছে, তবে এখন পর্যন্ত কেউ এটি পাঠোদ্ধার করতে পারেনি, যা সিন্ধু সভ্যতার রহস্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।


7. ধর্ম: সিন্ধু সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে বোঝা যায়, তারা মাতৃকেন্দ্রিক ধর্মে বিশ্বাস করত এবং উর্বরতা পূজায় নিয়োজিত ছিল। শিব বা পশুপতি দেবতার মতো কিছু দেবতা পূজা করত বলে ধারণা করা হয়।


8. প্রযুক্তি: সিন্ধু সভ্যতা সেচব্যবস্থা এবং নির্মাণ প্রযুক্তিতে অনেক অগ্রগতি করেছিল। তাদের ইটের তৈরি বাড়ি, নিষ্কাশন ব্যবস্থা, এবং স্নানের স্থানগুলোর প্রযুক্তিগত দক্ষতা ছিল অত্যন্ত উন্নত।


সিন্ধু সভ্যতার পতন

সিন্ধু সভ্যতা কেন এবং কিভাবে পতিত হলো, তা নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে। কিছু গবেষক মনে করেন যে জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা বা খরার কারণে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং শহরগুলো জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। অন্যরা মনে করেন যে আর্যদের আগমনের ফলে এই সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তবে, এর সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো অজানা।


সিন্ধু সভ্যতার গুরুত্ব

সিন্ধু সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ এবং উন্নত সভ্যতা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। তাদের উন্নত নগর পরিকল্পনা, শিল্পকলা, এবং বাণিজ্যিক দক্ষতা প্রাচীন বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতাগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল হিসেবে কাজ করেছে। যদিও তাদের লিপি এখনো পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, তবুও সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে আমরা তাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং উন্নত প্রযুক্তির অনেক দিক সম্পর্কে জানতে পারি।

Post a Comment

0 Comments