Recent Posts

মেসোপটেমীয় সভ্যতা



মেসোপটেমীয় সভ্যতা

মেসোপটেমিয়া হলো প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী সভ্যতা। শব্দটির অর্থ "নদীর মধ্যবর্তী ভূমি" (গ্রিক "মেসো" অর্থ মধ্যবর্তী, এবং "পটামোস" অর্থ নদী)। এটি প্রধানত টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত, যা আধুনিক ইরাকের অন্তর্ভুক্ত। মেসোপটেমিয়া হলো সেই অঞ্চলের নাম যেখানে বিশ্বের প্রথম সভ্যতাগুলোর উদ্ভব হয়েছিল, যেমন সুমের, ব্যাবিলন, এবং আসিরিয়া।


মেসোপটেমীয় সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ


1. ভৌগোলিক অবস্থান: মেসোপটেমিয়া মূলত বর্তমান ইরাক, কুয়েত, সিরিয়া, এবং তুরস্কের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদী মেসোপটেমিয়াকে উর্বর ভূমি প্রদান করত, যা কৃষির জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিল এবং সভ্যতার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।


2. প্রথম শহর এবং নগররাষ্ট্র: মেসোপটেমীয় সভ্যতায় পৃথিবীর প্রথম শহরগুলোর উদ্ভব হয়েছিল। সুমেরীয়রা সেখানে প্রথম নগররাষ্ট্র গড়ে তোলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শহর ছিল উর, উরুক, এবং লাগাশ। প্রতিটি নগররাষ্ট্রের নিজস্ব রাজা, আইন, এবং ধর্মীয় আচার ছিল।


3. শাসনব্যবস্থা: মেসোপটেমীয় সভ্যতার শাসনব্যবস্থা প্রধানত রাজতান্ত্রিক ছিল। প্রাচীনকালে সুমেরীয়রা প্রথম নগররাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, পরে একে একে আসিরিয়া ও ব্যাবিলনের মতো সম্রাজ্যের উদ্ভব হয়। ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবি তার বিখ্যাত আইনসংহিতা (Hammurabi’s Code) প্রণয়ন করেছিলেন, যা পৃথিবীর প্রথম লিখিত আইনের উদাহরণ।


4. ধর্ম: মেসোপটেমীয় সভ্যতা বহু দেব-দেবীর পূজার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। তাদের প্রধান দেবতা ছিল আন্নু (আকাশের দেবতা), এনলিল (বাতাস ও যুদ্ধের দেবতা), এবং ইনন্না (ভালোবাসা ও যুদ্ধের দেবী)। মেসোপটেমীয়রা দেবতাদের মন্দিরে পূজা করত এবং দেবতাদের প্রতি সম্মান দেখাতে বিশাল জিগুরাত (ধর্মীয় মন্দির) নির্মাণ করত।


5. লিপি ও ভাষা: মেসোপটেমীয়রা কিউনিফর্ম (cuneiform) নামে একটি প্রাচীন লিপি উদ্ভাবন করেছিল, যা বিশ্বের প্রথম লিখিত ভাষা। তারা মাটির ফলকে কিউনিফর্ম লিপির মাধ্যমে বিভিন্ন আইন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক লেনদেন লিখত। সুমেরীয়রা প্রথম এই লিপি ব্যবহার করেছিল।


6. কৃষি ও অর্থনীতি: মেসোপটেমীয় সভ্যতার অর্থনীতি প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর কারণে মেসোপটেমিয়া উর্বর অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল, যেখানে গম, যব, এবং অন্যান্য শস্য উৎপাদন করা হতো। এছাড়া তারা সেচব্যবস্থা উন্নত করেছিল। বাণিজ্যও মেসোপটেমীয় সভ্যতার একটি প্রধান অংশ ছিল এবং তারা পারস্য উপসাগর এবং অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য করত।


7. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: মেসোপটেমীয় সভ্যতা গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং স্থাপত্যবিদ্যায় অত্যন্ত উন্নত ছিল। তারা ৬০ ভিত্তিক গণনার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল, যা আধুনিক সময়ের সেকেন্ড এবং মিনিটের ভিত্তি। এছাড়া, তারা প্রথমে চাকা আবিষ্কার করেছিল, যা তাদের পরিবহনে বিপ্লব ঘটায়।


8. স্থাপত্য: মেসোপটেমীয় স্থাপত্যের মধ্যে জিগুরাত (মন্দির) উল্লেখযোগ্য। এটি একটি টাওয়ারের মতো ছিল যা ধাপে ধাপে তৈরি করা হতো। এছাড়া, তাদের সমাধি ও প্রাসাদগুলোর নির্মাণশৈলী অত্যন্ত উন্নত ছিল।


প্রধান সভ্যতাগুলো


1. সুমেরীয় সভ্যতা: মেসোপটেমিয়ার প্রথম সভ্যতা ছিল সুমেরীয় সভ্যতা। তারা নগররাষ্ট্রগুলোর উদ্ভাবক এবং কিউনিফর্ম লিপির উদ্ভাবক ছিল। সুমেরীয় সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে গড়ে ওঠে।


2. ব্যাবিলনীয় সভ্যতা: ব্যাবিলনীয়রা মেসোপটেমিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। তাদের শাসক হাম্মুরাবি তার বিখ্যাত আইনসংহিতা প্রণয়ন করেন। ব্যাবিলনের উল্লেখযোগ্য নির্মাণ ছিল ইশতার গেট এবং ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান, যা প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে ধরা হয়।


3. আসিরীয় সভ্যতা: আসিরীয়রা ছিল মেসোপটেমিয়ার অন্যতম সামরিক শক্তিধর সভ্যতা। তারা যুদ্ধ এবং সামরিক প্রযুক্তিতে পারদর্শী ছিল। আসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল নিনেভে।


মেসোপটেমীয় সভ্যতার গুরুত্ব

1. আইন ও প্রশাসন: মেসোপটেমীয় সভ্যতার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল হাম্মুরাবির আইনসংহিতা, যা আধুনিক আইনের ভিত্তি স্থাপন করে।

2. লিপি ও সাহিত্য: কিউনিফর্ম লিপি এবং মহাকাব্যিক সাহিত্য যেমন "গিলগামেশ মহাকাব্য" মেসোপটেমীয়দের অসামান্য সাহিত্যকীর্তির উদাহরণ।

3. বিজ্ঞান ও গণিত: তাদের উদ্ভাবিত ৬০ ভিত্তিক গণনা এবং জ্যোতির্বিদ্যা, যা আধুনিক বিজ্ঞান ও গণিতের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।


পতন ও উত্তরাধিকার

মেসোপটেমীয় সভ্যতা নানা আক্রমণ, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ধীরে ধীরে পতিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে পার্সিয়ানরা মেসোপটেমিয়া দখল করে। তবে মেসোপটেমীয় সভ্যতার অবদান পরবর্তী সভ্যতাগুলোর জন্য একটি স্থায়ী উত্তরাধিকার রেখে গেছে।

Post a Comment

0 Comments