Recent Posts

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান



১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন, যা পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের উত্থানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি মূলত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। এই অভ্যুত্থান ছিল ১৯৬৮ সালে শুরু হওয়া বিক্ষোভের একটি ফলশ্রুতি, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর আরও তীব্র হয়ে ওঠে।


পটভূমি

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান গঠিত হলে, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটি ভিন্ন ভৌগোলিক অংশে বিভক্ত হয়। যদিও পূর্ব পাকিস্তান জনসংখ্যার দিক থেকে বেশি ছিল এবং দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত, তবে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল। 


সামরিক শাসন

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন কার্যকর করে এবং ১৯৬২ সালে একটি নতুন সংবিধান কার্যকর করা হয়। কিন্তু আইয়ুব খানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকারের প্রতি তীব্র অবহেলা ছিল। তার শাসন আমলে সাধারণ মানুষের জন্য কোনো রাজনৈতিক মুক্তি ছিল না এবং তারা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত ছিল।


ছয় দফা আন্দোলন

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের একটি স্পষ্ট দাবি ছিল। এই আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কাছে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় এবং বাঙালির মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়িয়ে তোলে।


গণঅভ্যুত্থানের শুরু

১৯৬৮ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৬৯ সালের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। ছাত্র, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক মুক্তির জন্য সোচ্চার হয়। 


১. আসাদুজ্জামান হত্যাকাণ্ড

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তার মৃত্যু বাঙালির মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং এ ঘটনা গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম স্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠে।

২. সাধারণ ধর্মঘট

আসাদের মৃত্যুর পর ছাত্র ও যুব সমাজ বিভিন্ন বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করে। তারা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং সারা দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়। মানুষ রাজপথে নেমে আসে, রাজনৈতিক দাবির প্রতি সমর্থন জানায় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়।


গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা প্রবাহ

১. ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান

১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনসাধারণের আন্দোলন শুরু হয়। শ্রমিকরা, ছাত্ররা এবং সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবির পক্ষে সোচ্চার হয়। এই আন্দোলনটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন লাভ করে, যার মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিপ্লবী গণসংগঠন, ছাত্রলীগ, এবং অন্যান্য বামপন্থী দলগুলো ছিল।

২. পাকিস্তানি সরকারের দমনপীড়ন

পাকিস্তানি সরকার আন্দোলন দমন করতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। তারা ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে শুরু করে, কিন্তু এই দমনপীড়ন বাঙালির আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে। 


আন্দোলনের ফলাফল

১. আইয়ুব খানের পদত্যাগ

১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে আন্দোলনের চাপে পড়ে আইয়ুব খান সরকারের পতনের ঘোষণা দেন। তার পদত্যাগের ফলে একটি নতুন সরকার গঠন হয় এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়।

২. বঙ্গবন্ধুর মুক্তি

আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তখন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির মধ্যে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

৩. জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায় এবং মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে। 


উপসংহার - ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পূর্ব পাকিস্তানে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক ছিল, যা বাঙালি জনগণের রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবির পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে। এটি বাঙালিদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং ঐক্যের বীজ রোপণ করে, যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি তৈরি করে। 

Post a Comment

0 Comments