ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পরিচালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন। এটি ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে ওঠে। ছয় দফা দাবি ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটানো এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বাঙালিদের মুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা। ছয় দফা কর্মসূচি পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
ছয় দফা আন্দোলনের পটভূমি
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটি ভিন্ন ভৌগোলিক অংশে বিভক্ত হলেও, পশ্চিম পাকিস্তানই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রেখেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রশাসনিকভাবে অবহেলিত ছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও বাঙালিদের একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য:
- অর্থনৈতিক শোষণ: পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ উৎপাদন করলেও অর্থনীতির বেশিরভাগ সুবিধা পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত ছিল।
- রাজনৈতিক অবহেলা: পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণ বাংলা ভাষাভাষী হলেও তাদের রাজনৈতিক অধিকার বারবার অবহেলিত হচ্ছিল।
- সামরিক শাসন: ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হলে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আরও বেশি উপেক্ষিত হয়।
এই প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা আরও প্রবল হয়ে ওঠে এবং তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি সুস্পষ্ট কর্মসূচির প্রয়োজন দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
ছয় দফার মূল দাবি
৬ দফা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত করা। ছয়টি দাবির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটিয়ে একটি কার্যকর ফেডারেল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়। ছয় দফার প্রধান দাবি ছিল:
1. সরকারি ব্যবস্থা: পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে রূপান্তর করা হবে, যার শাসনব্যবস্থা হবে পার্লামেন্টারি, এবং আইনসভায় জনগণের সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় থাকবে।
2. রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি: কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কেবল দুটি বিষয় থাকবে: প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি। বাকি সকল বিষয়ে প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসন পাবে এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
3. মুদ্রা ও আর্থিক নীতি: পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক মুদ্রা চালু করা হবে, অথবা একটি অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অথচ নিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব থাকতে হবে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ করা হবে।
4. কর সংগ্রহ: প্রাদেশিক সরকারকে কর নির্ধারণ এবং সংগ্রহের ক্ষমতা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার কোনও কর আদায় করতে পারবে না এবং সব ধরণের রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে।
5. বিদেশি বাণিজ্য: পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নিজস্ব বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি থাকতে হবে এবং প্রদেশগুলো নিজেদের বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারবে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
6. মিলিশিয়া ও প্যারামিলিটারি বাহিনী: পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি পৃথক মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন করতে হবে, যা তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
ছয় দফার গুরুত্ব ও প্রতিক্রিয়া
পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া
- বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া: ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এটি ছিল বাঙালিদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের অবসানের জন্য একটি সুস্পষ্ট কর্মসূচি। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
- কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা: পাকিস্তানের সামরিক সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ছয় দফার তীব্র বিরোধিতা করে। তারা ছয় দফাকে পাকিস্তানের বিভাজনের পরিকল্পনা হিসেবে আখ্যা দেয়। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফার মাধ্যমে পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট হবে বলে মনে করেন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব
- শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় নেতৃত্ব: শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছয় দফার পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি ছয় দফা কর্মসূচিকে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ছয় দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও জনসভায় ছুটে বেড়ান এবং জনগণের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেন।
ছয় দফা আন্দোলনের ফলাফল
১. ছয় দফার কারণে গ্রেফতার ও মামলা
১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগ ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ধর্মঘট ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। এতে পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন নিহত হন এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়, তবে এটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে আরও ক্ষোভ তৈরি করে।
২. বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান
ছয় দফা আন্দোলন বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটায়। বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, তাদের অধিকার আদায়ের একমাত্র উপায় হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন, যা পরে স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ছয় দফা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ঐক্য এবং জাতীয় চেতনা গড়ে তোলে।
৩. ১৯৭০ সালের নির্বাচন
ছয় দফা আন্দোলনের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে, যা পাকিস্তানের শাসন কাঠামোতে বাঙালির রাজনৈতিক শক্তি নিশ্চিত করে। তবে পশ্চিম পাকিস্তান এ নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে রাজি হয়নি, যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়।
৪. ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিকে অগ্রগতি
ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ছয় দফার দাবির মধ্য দিয়ে বাঙালিরা প্রথমবারের মতো তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবি স্পষ্টভাবে জানায়। এই আন্দোলন ধীরে ধীরে একটি বৃহত্তর মুক্তির সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়, যা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করে।
উপসংহার
ছয় দফা আন্দোলন ছিল বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সুসংগঠিত পদক্ষেপ। এটি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের এক সুস্পষ্ট কর্মসূচি হিসেবে কাজ করে। ছয় দফার দাবি ছিল স্বাধীনতার পথের একটি মাইলফলক, যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দিকে ধাবিত করে।
0 Comments