পাঠ-১
লেখক পরিচিতি
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার নৈহাটির কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। তাঁদের পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন হুগলির ডেপুটি কালেক্টর। সঞ্জীবচন্দ্র মেদিনীপুর জেলা স্কুল ও হুগলি কলেজে পড়াশুনা করেন এবং নিজের চেষ্টায় ইংরেজি সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ইতিহাসে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি বর্ধমান কমিশনার অফিসে কেরানি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তিনি বঙ্কিমচন্দ্র প্রবর্তিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। ভ্রমণসাহিত্যের লেখক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে সঞ্জীবচন্দ্র স্মরণীয় হয়ে আছেন। ভ্রমণকাহিনি ‘পালামৌ’ তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। ‘প্রমথনাথ বসু’ ছদ্মনামে এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি বিহারের পালামৌ ও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করেন। ‘পালামৌ’ ভ্রমণ-বৃত্তান্তে সৌন্দর্যের প্রতি লেখকের যে অকৃত্রিম অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে এমন বাঙালি লেখকদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। এছাড়াও ‘কণ্ঠমালা’ (১৮৭৭) ও ‘মাধবীলতা’ (১৮৮৪) তাঁর দুটি উপন্যাস। ‘জলপ্রতাপ চাঁদ’ (১৮৮৩) তাঁর ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস। তাঁর দুটি গল্পগ্রন্থের নাম ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’ ও ‘দামিনী’। ১৮৮৯ সালে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন।
ভূমিকা
‘পালামৌ’ রচনাটি সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ নামক ভ্রমণোপন্যাস থেকে সংকলিত ও সম্পাদিত হয়েছে। এ রচনায় লেখক বিহারের (বর্তমান ঝাড়খণ্ডের) পালামৌ অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি স্থান-কাল-পাত্রভেদে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য, দেশভ্রমণের আনন্দ, অভিজ্ঞতা এবং পালামৌ-এর আদিবাসী কোলদের জীবনাচরণ, খাদ্য ও আনন্দ-বিনোদন প্রভৃতি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন।
মূলপাঠ
বহুকাল হইল আমি একবার পালামৌ প্রদেশে গিয়াছিলাম, প্রত্যাগমন করিলে পর সেই অঞ্চলের বৃত্তান্ত লিখিবার নিমিত্ত দুই-এক জন বন্ধুবান্ধব আমাকে পুনঃপুন অনুরোধ করিতেন, আমি তখন তাঁহাদের উপহাস করিতাম। এক্ষণে আমায় কেহ অনুরোধ করে না, অথচ আমি সেই বৃত্তান্ত লিখিতে বসিয়াছি। গল্প করা এ বয়সের রোগ, কেহ শুনুন বা না-শুনুন, বৃদ্ধ গল্প করে।
অনেক দিনের কথা লিখিতে বসিয়াছি, সকল স্মরণ হয় না। পূর্বে লিখিলে যাহা লিখিতাম, এক্ষণে যে তাহাই লিখিতেছি এমত নহে। পূর্বে সেই সকল নির্জন পর্বত, কুসুমিত কানন প্রভৃতি যে-চক্ষে দেখিয়াছিলাম, সে চক্ষু আর নাই। এখন পর্বত কেবল প্রস্তরময়, বন কেবল কণ্টকাকীর্ণ, অধিবাসীরা কেবল কদাচারী বলিয়া স্মরণ হয়।
যখন পালামৌ আমার যাওয়া একান্ত স্থির হইল, তখন ইন্ল্যান্ড ট্রাঞ্জিট কোম্পানির ডাকগাড়ি ভাড়া করিয়া রাত্রি দেড় প্রহরের সময় রানিগঞ্জ হইতে যাত্রা করিলাম। প্রাতে বরাকর নদীর পূর্বপারে গাড়ি থামিল। নদী অতি ক্ষুদ্র, তৎকালে অল্পমাত্র জল ছিল, সকলেই হাঁটিয়া পার হইতেছে, গাড়ি ঠেলিয়া পার করিতে হইবে, অতএব গাড়ওয়ান কুলি ডাকিতে গেল। এমত সময় কুলিদের কতকগুলি বালক বালিকা আসিয়া আমার গাড়ি ঘেরিল। ‘সাহেব একটি পয়সা, সাহেব একটি পয়সা।’ এই বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল।
তাহাদের সঙ্গে একটি দুই বৎসর বয়স্ক শিশুও আসিয়া আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া হাত পাতিয়া দাঁড়াইল। কেন হাত পাতিল তাহা সে জানে না, সকলে হাত পাতিয়াছে দেখিয়া সেও হাত পাতিল। আমি তাহার হস্তে একটি পয়সা দিলাম, শিশু তাহা ফেলিয়া দিয়া আবার হাত পাতিল, অন্য বালক সে পয়সা কুড়াইয়া লইলে শিশুর ভগিনীর সহিত তাহার তুমুল কলহ বাধিল। এই সময় আমার গাড়ি অপর পারে গিয়া উঠিল।
বরাকর হইতে দুই-একটি ক্ষুদ্র পাহাড় দেখা যায়। বঙ্গবাসীদের কেবল মাঠ দেখা অভ্যাস, মৃত্তিকার সামান্য স্তূপ দেখিলেই তাহাদের আনন্দ হয়। অতএব সেই ক্ষুদ্র পাহাড়গুলি দেখিয়া-যে তৎকালে আমার যথেষ্ট আনন্দ হইবে ইহা আর আশ্চর্য কী?
অপরাহ্ণে দেখিলাম একটি সুন্দর পর্বতের নিকট দিয়া গাড়ি যাইতেছে। এত নিকট দিয়া যাইতেছে যে, পর্বতস্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরের ছায়া পর্যন্ত দেখা যাইতেছে। গাড়ওয়ানকে গাড়ি থামাইতে বলিয়া আমি নামিলাম। গাড়ওয়ান জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোথা যাইবেন?’ আমি বলিলাম, ‘একবার এই পর্বতে যাইব।’ সে হাসিয়া বলিল, ‘পাহাড় এখান হইতে অনেক দূর, আপনি সন্ধ্যার মধ্যে তথায় পৌঁছিতে পারিবেন না।’ আমি এ-কথা কোনোরূপে বিশ্বাস করিলাম না। আমি স্পষ্ট দেখিতেছিলাম, পাহাড় অতি নিকট, তথা যাইতে আমার পাঁচ মিনিটও লাগিবে না, অতএব গাড়ওয়ানের নিষেধ না-শুনিয়া আমি পর্বতাভিমুখে চলিলাম।
পাঁচ মিনিটের স্থলে ১৫ মিনিটকাল দ্রুতপদবিক্ষেপে গেলাম, তথাপি পর্বত পূর্বমতো সেই পাঁচ মিনিটের পথ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তখন আমার ভ্রম বুঝিতে পারিয়া গাড়িতে ফিরিয়া আসিলাম। পর্বত সম্বন্ধে দূরতা স্থির করা বাঙ্গালীর পক্ষে বড় কঠিন, ইহার প্রমাণ পালামৌ গিয়া আমি পুনঃপুন পাইয়াছিলাম।
পরদিবস প্রায় দুই প্রহরের সময় হাজারিবাগ পৌঁছিলাম। তথায় গিয়া শুনিলাম, কোনো সম্ভ্রান্ত বঙ্গবাসীর বাটীতে আমার আহারের আয়োজন হইতেছে।
যে বঙ্গবাসীর গৃহে আতিথ্য স্বীকার করিতে যাইতেছিলাম, তথায় গিয়া গাড়ি থামিলে আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম। আমাকে দেখিয়া তাঁহারা সকলেই সাদরে অগ্রসর হইলেন। না চিনিয়া যাঁহার অভিবাদন আমি সর্বাগ্রে গ্রহণ করিয়াছিলাম, তিনিই বাটীর কর্তা। সেখানে তিন শত লোক থাকিলেও আমার দৃষ্টি বোধহয় প্রথমেই তাঁহার মুখের প্রতি পড়িত। সেরূপ প্রসন্নতাব্যঞ্জক ওষ্ঠ আমি অতি অল্প দেখিয়াছি। তখন তাঁহার বয়ঃক্রম বোধহয় পঞ্চাশ অতীত হইয়াছিল, বৃদ্ধের তালিকায় তাঁহার নাম উঠিয়াছিল, তথাপি তাঁহাকে বড় সুন্দর দেখিয়াছিলাম। বোধহয় সেই প্রথম আমি বৃদ্ধকে সুন্দর দেখি।
যে সময়ের কথা বলিতেছি, আমি তখন নিজে যুবা; অতএব সে বয়সে বৃদ্ধকে সুন্দর দেখা ধর্মসঙ্গত নহে। কিন্তু সে দিবস এরূপ ধর্মবিরুদ্ধ কার্য ঘটিয়াছিল। এক্ষণে আমি নিজে বৃদ্ধ, কাজেই প্রায় বৃদ্ধকে সুন্দর দেখি। একজন মহানুভব বলিয়াছিল যে, মনুষ্য বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না।
আহারান্তে বিশ্রামগৃহে বসিয়া বালকদিগের সহিত গল্প করিতে করিতে বালকদের শয়নঘর দেখিতে উঠিয়া গেলাম। ঘরটি বিলক্ষণ পরিসর, তাহার চারি কোণে চারিখানি খাট পাতা, মধ্যস্থলে আর-একখানি খাট রহিয়াছে। জিজ্ঞাসা করায় বালকেরা বলিল, ‘চারি কোণে আমরা চারিজন শয়ন করি, আর মধ্যস্থলে মাস্টার মহাশয় থাকেন।’ এই বন্দোবস্ত দেখিয়া বড় পরিতৃপ্ত হইলাম। দিবারাত্র ছাত্রদের কাছে শিক্ষক থাকার আবশ্যকতা অনেকে বুঝেন না।
বালকদের শয়নঘর হইতে বহির্গত হইয়া আর-একঘরে দেখি, এক কাঁদি সুপক্ব মর্তমান রম্ভা দোদুল্যমান রহিয়াছে, তাহাতে একখানি কাগজ ঝুলিতেছে। পড়িয়া দেখিলাম, নিত্য যত কদলী কাঁদি হইতে ব্যয় হয়, তাহাই তাহাতে লিখিত হইয়া থাকে! লোকে সচরাচর ইহাকে ক্ষুদ্র দৃষ্টি, ছোটনজর ইত্যাদি বলে : কিন্তু আমি তাহা কোনোরূপে ভাবিতে পারিলাম না। যেরূপ অন্যান্য বিষয়ের বন্দোবস্ত দেখিলাম, তাহাতে ‘কলাকাঁদির হিসাব’ দেখিয়া বরং আরো চমৎকৃত হইলাম। যাহাদের দৃষ্টি ক্ষুদ্র তাহারা কেবল সামান্য বিষয়ের প্রতিই দৃষ্টি রাখে, অন্য বিষয় দেখিতে পায় না। কিন্তু আমি যাঁহার কথা বলিতেছি, দেখিলাম তাঁহার নিকট বৃহৎ সূক্ষ সকলই সমভাবে পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। অনেকে আছেন, বড় বড় বিষয় মোটামুটি দেখিতে
পারেন, কিন্তু সূক্ষ বিষয়ের প্রতি তাঁহাদের দৃষ্টি একেবারে পড়ে না। তাঁহাদের প্রশংসা করি না। যাঁহারা বৃহৎ সূক্ষ একত্র দেখিয়া কার্য করেন, তাঁহাদেরই প্রশংসা করি। আমি ভাবিয়াছিলাম পালামৌ প্রবল শহর, সুখের স্থান। তখন জানিতাম না যে পালামৌ শহর নহে, একটি প্রকাণ্ড পরগনামাত্র। শহর সে অঞ্চলেই নাই, নগর দূরে থাকুক, তথায় একখানি গণ্ডগ্রামও নাই, কেবল পাহাড় ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ।
রাঁচি হইতে পালামৌ যাইতে যাইতে যখন বাহকগণের নির্দেশমতো দূর হইতে পালামৌ দেখিতে পাইলাম, তখন আমার বোধ হইল যেন মর্তে মেঘ করিয়াছে। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া সেই মনোহর দৃশ্য দেখিতে লাগিলাম। ঐ অন্ধকার মেঘমধ্যে এখনই যাইব এই মনে করিয়া আমার কতই আহ্লাদ হইতে লাগিল। কতক্ষণে পৌঁছিব মনে করিয়া আবার কতই ব্যস্ত হইলাম।
পালামৌ প্রবেশ করিয়া দেখিলাম নদী, গ্রাম সকলই আছে, দূর হইতে তাহা কিছুই দেখা যায় নাই। পালামৌ পরগনায় পাহাড় অসংখ্য, পাহাড়ের পর পাহাড়, তাহার পর পাহাড়, আবার পাহাড়; যেন বিচলিত নদীর সংখ্যাতীত তরঙ্গ। সেখানে একবার একটি পাহাড় দেখিয়া চমৎকৃত হইয়াছিলাম। সেটি একশিলা, সমুদয়ে একখানি প্রস্তর। তাহাতে একেবারে কোথাও কণামাত্র মৃত্তিকা নাই, সমুদয় পরিষ্কার ঝরঝর করিতেছে। তাহার একস্থান অনেক দূর পর্যন্ত ফাটিয়া গিয়াছে, সেই ফাটার উপর বৃহৎ এক অশ্বত্থগাছ জন্মিয়াছে। তখন মনে হইয়াছিল, অশ্বত্থবৃক্ষ বড় রসিক, এই নীরস পাষাণ হইতেও রসগ্রহণ করিতেছে। কিছুকাল পরে আর একদিন এই অশ্বত্থগাছ আমার মনে পড়িয়াছিল, তখন ভাবিয়াছিলাম বৃক্ষটি বড় শোষক, ইহার নিকট নীরস পাষাণেরও নিস্তার নাই।
নির্বাচিত শব্দের অর্থ ও টীকা :
এক কাঁদি সুপক্ব মর্তমান রম্ভা- এক ছড়া সুন্দরভাবে বা পরিপূর্ণরূপে পাকা কলা। কণ্টকাকীর্ণ- কাঁটায় পরিপূর্ণ; দুর্গম। কদাচারী- কুৎসিত বা জঘন্য আচরণ যার। কুসুমিত কানন- ফুলশোভিত বাগান; ফুলেল বাগান। গণ্ডগ্রাম- ক্ষুদ্র গ্রাম। গাড়োয়ান- গাড়ি চালায় যে। ডাকগাড়ি- ডাকবাহী দ্রুতগামী গাড়ি; চিঠিপত্র বহনকারী গাড়ি। দ্রুতপদবিক্ষেপে- দ্রুত বা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে যাওয়া। পরিসর- ব্যাপ্তি; বিস্তার। প্রকাণ্ড- অতিবৃহৎ, বিশাল। প্রস্তরময়- পাথরের মতো। প্রসন্নতাব্যঞ্জক- আনন্দ বা সন্তুষ্টি প্রকাশক। প্রত্যাগমন- ফিরে আসা। বাটী- বাড়ি। বিলক্ষণ- ভালো রকম; অসামান্য। মর্তমান- এক জাতীয় কলা। মৃত্তিকার সামান্য স্তূপ- ছোট টিলা; উঁচু জায়গা। রম্ভা- কলা। শয়নঘর- শোবার ঘর। সাদরে- আদরের সঙ্গে।
সারসংক্ষেপ :
লেখক যৌবনে পালামৌ প্রদেশে গিয়েছিলেন। পালামৌ পাহাড়-অরণ্যে ঘেরা সুন্দর জায়গা। সমতলবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে সে পরিবেশ খুব একটা পরিচিত নয়। পথে যেতে যেতে যে পাহাড়কে খুব কাছে মনে হয়, সে পাহাড় আসলে অনেক দূরে অবস্থিত -এ অভিজ্ঞতাও লেখকের জন্য নতুন। যে বাঙালির বাড়িতে তিনি সেখানে অতিথি হয়েছিলেন, সে গৃহকর্তার প্রসন্ন মুখ আর তার পরিবার-ব্যবস্থাপনা লেখককে মুগ্ধ করেছিল।
পাঠ-২
মূলপাঠ
অপরাহ্ণে পালামৌয়ে প্রবেশ করিয়া উভয়পার্শ্বস্থ পর্বতশ্রেণি দেখিতে দেখিতে বনমধ্য দিয়া যাইতে লাগিলাম। বন বর্ণনায় যেরূপ ‘শাল তাল তমাল, হিন্তাল’ শুনিয়াছিলাম, সেরূপ কিছুই দেখিতে পাইলাম না। তা, হিন্তাল একেবারেই নাই, কেবল শালবন, অন্য বন্য গাছও আছে। শালের মধ্যে প্রকাণ্ড গাছ একটিও নাই, সকলগুলিই আমাদের দেশি কদম্ববৃক্ষের মতো, না হয় কিছু বড়; কিন্তু তাহা হইলেও জঙ্গল অতি দুর্গম, কোথায়ও তাহার ছেদ নাই, এইজন্য ভয়ানক। এইরূপ বন দিয়া যাইতে যাইতে এক স্থানে হঠাৎ কাষ্ঠঘণ্টার বিস্ময়কর শব্দ কর্ণগোচর হইল, কাষ্ঠঘণ্টা পূর্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে দেখিয়াছিলাম। গৃহপালিত পশু বনে পথ হারাইলে, শব্দানুসরণ করিয়া তাহাদের অনুসন্ধান করিতে হয়, এইজন্য গলঘণ্টার উৎপত্তি। কাষ্ঠঘণ্টার শব্দ শুনিলে প্রাণের ভিতর কেমন করে। পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে সে শব্দে আরো যেন অবসন্ন করে; কিন্তু সকলকে করে কি না, তাহা বলিতে পারি না।
অল্প বিলম্বেই অর্ধশুষ্ক তৃণাবৃত একটি ক্ষুদ্র প্রান্তর দেখা গেল, এখানে-সেখানে দুই-একটি মধু বা মৌয়াবৃক্ষ ভিন্ন সে-প্রান্তরে গুল্ম কি লতা কিছুই নাই, সর্বত্র অতি পরিষ্কার। পর্বতছায়ায় সে-প্রান্তর আরো রম্য হইয়াছে; তথায় কতকগুলি কোলবালক একত্র মহিষ চরাইতেছিল, সেরূপ কৃষ্ণবর্ণ কান্তি আর কখনো দেখি নাই; সকলের গলায় পুঁতির সাতনরী, ধুক্ধুকির পরিবর্তে এক-একখানি গোল আরশি; পরিধানে ধড়া, কর্ণে বনফুল; কেহ মহিষপৃষ্ঠে শয়ন করিয়া আছে, কেহবা মহিষপৃষ্ঠে বসিয়া আছে, কেহ কেহ নৃত্য করিতেছে। যেরূপ স্থান তাহাতে এই পাথুরে ছেলেগুলি উপযোগী বলিয়া বিশেষ সুন্দর দেখাইতেছিল; চারিদিকে কালো পাথর, পশুও পাথুরে; তাহাদের রাখালও সেইরূপ।
এই অঞ্চলে প্রধানত কোলের বাস। কোলেরা বন্য জাতি, খর্বাকৃতি, কৃষ্ণবর্ণ; দেখিতে কুৎসিত কি রূপবান তাহা আমি মীমাংসা করিতে পারি না! যে-সকল কোল কলিকাতা আইসে বা চা-বাগানে যায় তাহাদের মধ্যে আমি কাহাকেও রূপবান দেখি নাই; বরং অতি কুৎসিত বলিয়া বোধ করিয়াছি। কিন্তু ¯^দেশে কোলমাত্রেই রূপবান, অন্তত আমার চক্ষে। বন্যেরা বনে সুন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
প্রান্তরের পর এক ক্ষুদ্র গ্রাম, তাহার নাম স্মরণ নাই; তথায় ত্রিশ-বত্রিশটি গৃহস্থ বাস করে। সকলেরই পর্ণকুটির। আমার পালকি দেখিতে যাবতীয় স্ত্রীলোক ছুটিয়া আসিল। সকলেই আবলুসের মতো কালো, সকলেই যুবতী, সকলের কটিদেশে একখানি করিয়া ক্ষুদ্র কাপড় জড়ানো। কর্ণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বনফুল, মাথায় বড় বড় বনফুল। যুবতীরা পরস্পর কাঁধ ধরাধরি করিয়া দেখিতে লাগিল।
বাঙ্গালার পথেঘাটে বৃদ্ধাই অধিক দেখা যায়, কিন্তু পালামৌ অঞ্চলে যুবতীই অধিক দেখা যায়। কোলের মধ্যে বৃদ্ধা অতি অল্প, তাহারা অধিকবয়সী হইলেও যুবতীই থাকে, অশীতিপরায়ণা না হইলে তাহারা লোলচর্মা হয় না। অতিশয় পরিশ্রমী বলিয়া গৃহকার্য কৃষিকার্য সকল কার্যই তাহারা করে। পুরুষেরা স্ত্রীলোকের ন্যায় কেবল বসিয়া সন্তান রক্ষা করে, কখনো কখনো চাটাই বুনে। আলস্য জন্য পুরুষেরা বঙ্গমহিলাদের ন্যায় শীঘ্র বৃদ্ধ হইয়া যায়, স্ত্রীলোকেরা শ্রমহেতু চিরযৌবনা থাকে। লোকে বলে পশুপক্ষীর মধ্যে পুরুষজাতিই বলিষ্ঠ ও সুন্দর; মনুষ্যমধ্যেও সেই নিয়ম। কিন্তু কোলদের দেখিলে তাহা বোধহয় না,
তাহাদের স্ত্রীজাতিরাই বলিষ্ঠ ও আশ্চর্য কান্তিবিশিষ্টা। কিন্তু তাহাদের বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষদের গায়ে খড়ি উঠিতেছে, চক্ষে মাছি উড়িতেছে, মুখে হাসি নাই, যেন সকলেরই জীবনীশক্তি কমিয়া আসিয়াছে। একদিনের কথা বলি। যেরূপ নিত্য অপরাহ্ণে এই পাহাড়ে যাইতাম সেইরূপ আর একদিন যাইতেছিলাম, পথে দেখি একটি যুবা বীরদর্পে পাহাড়ের দিকে যাইতেছে, পশ্চাতে কতকগুলি স্ত্রীলোক তাহাকে সাধিতে সাধিতে সঙ্গে যাইতেছে।
একদিনের কথা বলি। যেরূপ নিত্য অপরাহ্ণে এই পাহাড়ে যাইতাম সেইরূপ আর একদিন যাইতেছিলাম, পথে দেখি একটি যুবা বীরদর্পে পাহাড়ের দিকে যাইতেছে, পশ্চাতে কতকগুলি স্ত্রীলোক তাহাকে সাধিতে সাধিতে সঙ্গে যাইতেছে। যখন আমি নিকটবর্তী হইলাম তখন স্ত্রীলোকেরা নিরস্ত হইয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইল। বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করায় যুবা সদর্পে বলিল, ‘আমি বাঘ মারিতে যাইতেছি, এই মাত্র আমার গোরুকে বাঘে মারিয়াছে। আমি ব্রাহ্মণ-সন্তান; সে বাঘ না মারিয়া কোন মুখে আর জল গ্রহণ করি ?’ আমি কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইয়া বলিলাম, ‘চল, আমি তোমার সঙ্গে যাইতেছি।’
আমি স্বাভাবত বড় ভীত, তাহা বলিয়া ব্যাঘ্র-ভলু−ক সম্বন্ধে আমার কখনো ভয় হয় নাই। বৃদ্ধ শিকারিরা কতদিন পাহাড়ে একাকী যাইতে আমায় নিষেধ করিয়াছে, কিন্তু আমি তাহা কখনো গ্রাহ্য করি নাই, নিত্য একাকী যাইতাম, বাঘ আসিবে, আমায় ধরিবে, আমায় খাইবে, এ সকল কথা কখনো আমার মনে আসিত না। কেন আসিত না তাহা আমি এখনো বুঝিতে পারি না। সৈনিক পুরুষদের মধ্যে অনেকে আপনার ছায়া দেখিয়া ভয় পায়, অথচ অম্লান বদনে রণক্ষেত্রে গিয়া রণ করে।
গুলি কি তরবারি তাহার অঙ্গে প্রবিষ্ট হইবে এ-কথা তাহাদের মনে আইসে না। যতদিন তাহাদের মনে এ-কথা না আইসে, ততদিন লোকের নিকট তাহারা সাহসী; যে বিপদ না বুঝে সেই সাহসী। আদিম অবস্থায় সকল পুরুষই সাহসী ছিল, তাহাদের তখন ফলাফল জ্ঞান হয় নাই। জঙ্গলীদের মধ্যে অদ্যাপি দেখা যায়, সকলেই সাহসী, ইউরোপীয় সভ্যদের অপেক্ষাও অনেক অংশে সাহসী; হেতু ফলাফল বোধ নাই। আমি তাই আমার সাহসের বিশেষ গৌরব করি না। সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে সাহসের ভাগ কমিয়া আইসে; পেনাল কোড যত ভালো হয় সাহস তত অন্তর্হিত হয়।
একদিন অপরাহ্ণে পাহাড়ের দিকে যাইতেছিলাম, পথিমধ্যে কতকগুলো কোলকন্যার সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহাদের মধ্যে যে সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠা, মাথায় পূর্ণ কলস দুই হস্তে ধরিয়া হাস্যমুখে আমায় বলিল, ‘রাত্রে নাচ দেখিতে আসিবেন?’ আমি মাথা হেলাইয়া স্বীকার করিলাম, অমনি সকলে হাসিয়া উঠিল। কোলের যুবতীরা যত হাসে, যত নাচে, বোধহয় পৃথিবীর আর কোনো জাতির কন্যারা তত হাসিতে নাচিতে পারে না; আমাদের দুরন্ত ছেলেরা তাহার শতাংশ পারে না।
সন্ধ্যার পর আমি নৃত্য দেখিতে গেলাম; গ্রামের প্রান্তভাগে এক বটবৃক্ষতলে গ্রামস্থ যুবারা সমুদয়ই আসিয়া একত্র হইয়াছে। তাহারা ‘খোঁপা’ বাাঁধিয়াছে, তাহাতে দুই-তিনখানি কাঠের ‘চিরুনি’ সাজাইয়াছে। কেহ মাদল আনিয়াছে, কেহবা লম্বা লাঠি আনিয়াছে, রিক্তহস্তে কেহ আসে নাই; বয়সের দোষে সকলেরই দেহ চঞ্চল, সকলেই নানাভঙ্গিতে আপন আপন বলবীর্য দেখাইতেছে। বৃদ্ধেরা বৃক্ষমূলে উচ্চ মৃন্ময়-মঞ্চের উপর জড়বৎ বসিয়া আছে, তাহাদের জানু প্রায় স্কন্ধ ছাড়াইয়াছে। আমি গিয়া তাহাদের পার্শ্বে বসিলাম।
এই সময় দলে দলে গ্রামস্থ যুবতীরা আসিয়া জমিতে লাগিল; তাহারা আসিয়াই যুবাদিগের প্রতি উপহাস আরম্ভ করিল, সঙ্গে সঙ্গে বড় হাসির ঘটা পড়িয়া গেল। উপহাস আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; কেবল অনুভবে স্থির করিলাম যে যুবারা ঠকিয়া গেল। ঠকিবার কথা, যুবা দশ-বারোটা, কিন্তু যুবতীরা প্রায় চল্লিশ জন, সেই চল্লিশ জনে হাসিলে হাইলন্ডের পল্টন ঠকে।
হাস্য-উপহাস্য শেষ হইলে, নৃত্যের উদ্যোগ আরম্ভ হইল। যুবতী সকলে হাত ধরাধরি করিয়া অর্ধচন্দ্রাকৃতি রেখাবিন্যাস করিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে বড় চমৎকার হইল। সকলগুলিই সম-উচ্চ, সকলগুলিই পাথুরে কালো। সকলের মাথায় বনপুষ্প, কর্ণে বনপুষ্প, ওষ্ঠে হাসি। সকলেই আহ্লাদে পরিপূর্ণ, আহ্লাদে চঞ্চল।
বৃদ্ধেরা ইঙ্গিত করিলে যুবাদের দলে মাদল বাজিল, অমনি যুবতীদের দেহ যেন শিহরিয়া উঠিল; পরেই তাহারা নৃত্য আরম্ভ করিল। তাহাদের নৃত্য আমাদের চক্ষে নতুন, তাহারা তালে তালে পা ফেলিতেছে, অথচ কেহ চলে না; দোলে না, টলে না। যে যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, সে সেইখানেই দাঁড়াইয়া তালে তালে পা ফেলিতে লাগিল।
নৃত্য আরম্ভ হইলে পর এক বৃদ্ধ মঞ্চ হইতে কম্পিত কণ্ঠে একটি গীতের ‘মহড়া’ আরম্ভ করিল, অমনি যুবারা সেই গীত উচ্চস্বরে গাহিয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে যুবতীরা তীব্র তানে ‘ধুয়া’ ধরিল। যুবতীদের সুরের ঢেউ নিকটের পাহাড়ে গিয়া লাগিতে লাগিল।
যুবতীরা তালে তালে নাচিতেছে, তাহাদের মাথার বনফুল সেইসঙ্গে উঠিতেছে নামিতেছে, আবার সেই ফুলের দুটি-একটি ঝরিয়া তাহাদের স্কন্ধে পড়িতেছে। শীতকাল নিকটে, দুই-তিন স্থানে হু হু করিয়া অগ্নি জ্বলিতেছে, অগ্নির আলোকে নর্তকীদের বর্ণ আরো কালো দেখাইতেছে; তাহারা তালে তালে নাচিতেছে, নাচিতে নাচিতে ফুলের পাপড়ির ন্যায় সকলে একবার ‘চিতিয়া’ পড়িতেছে, আকাশ হইতে চন্দ্র তাহা দেখিয়া হাসিতেছে, আর বটমূলের অন্ধকারে বসিয়া আমি হাসিতেছি।
অপরিচিত শব্দের অর্থ ও টীকা :
অদ্যাপি- আজও; এখনো। অনুসন্ধান- খোঁজ করা। অম্লান- অমলিন; প্রফুল্ল। অশীতিপরায়ণা- আশির অধিক বয়স বিশিষ্ট বৃদ্ধা। একশিলা- পুরোটা একটি প্রস্তর। কাষ্টঘণ্টা- গৃহপালিত পশু খোঁজার ঘণ্টা। কোলবালক- কোল সম্প্রদায়ভুক্ত বালক। কান্তি- লাবণ্য; সৌন্দর্য। খর্বাকৃতি- বামন; বেঁটে। গলঘন্টা- গলায় বা কণ্ঠদেশে বাঁধা ঘণ্টা। জানু- হাঁটু। ধড়া- ধুতি; চীরবস্ত্র। ধুক্ধুকি- কণ্ঠহারের লকেট। ধুয়া- গানের যে অংশ দোহারগণ বার বার গায় (chorus)। পরগনা- অনেকগুলো গ্রামের সমষ্টি। পাথুরে ছেলেগুলি- পাহাড়ি ছেলেগুলো সাধারণত কালো ও পরিশ্রমী হয়। পেনাল কোড- ফৌজদারি মামলার দণ্ডবিধি। প্রবিষ্ট- প্রবেশ করেছে এমন। বদন- মুখমণ্ডল। বয়োজ্যেষ্ঠা- বয়সে বড় বা অধিক বয়স্ক নারী। বীরদর্পে- শক্তির সাথে; সাহসের সাথে। মহড়া- প্রস্তুতি; অভিনয়ের বা যুদ্ধের প্রস্তুতি। মৃন্ময়-মাটির তৈরি; মৃত্তিকা নির্মিত। যেন মর্তে মেঘ করিয়াছে- পাহাড় এবং চারপাশের পরিবেশের ঘনত্ব বোঝাতে এ উপমাটি প্রয়োগ করা হয়েছে; রণক্ষেত্র- যেখানে যুদ্ধ চলছে; যুদ্ধক্ষেত্র। লোলচর্মা- শিথিল বা ঢিলা চামড়া। শ্রমহেতু চিরযৌবনা- পাহাড়ি এই মেয়েরা পরিশ্রমী হওয়ায় সহসা বৃদ্ধ হয় না। সাতনরী- সাত প্যাচের কণ্ঠহার; গলার মালা। স্কন্ধ- কাঁধ ।
সারসংক্ষেপ :
লেখক পালামৌয়ে পাহাড়ে-অরণ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেখানকার প্রধান জনগোষ্ঠী কোলদের সঙ্গেও তাঁর মেলামেশার সুযোগ হয়েছে। এক প্রান্তরে কোল-বালকদের মহিষ চরাতে দেখলেন। কোল নারী-পুরুষও দেখলেন। সেই পরিবেশে, নিজেদের অঞ্চলে এই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মানুষগুলোকেই তাঁর অতিশয় সুন্দর মনে হল। এক সন্ধ্যায় তিনি গিয়েছিলেন কোলদের নাচ দেখতে। ওই পাহাড়-বনের পরিবেশে রাতের আগুনের আলোয় কোল যুবক-যুবতীদের সম্মিলিত নাচ-গান তাঁকে মুগ্ধ করল।
সৃজনশীল প্রশ্ন-১
বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলার পাহাড় আর টিলাগুলো যেন এক বিশেষ শ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। প্রথমেই দেখা যায় নিচুপাহাড়। তারপর উঁচু পাহাড়। তার উত্তরে আরও উঁচু পাহাড়ের সারি। শহর এ এলাকায় নেই বললেই চলে। এমনকি গণ্ডগ্রাম পাওয়াও দুষ্কর। এখানে আছে কেবল পাহাড় আর পাহাড় আর তা জঙ্গলে পরিপূর্ণ।
ক. ‘পালামৌ’ লেখকের কোন ধরনের রচনা?
খ. ‘মৃত্তিকার দুএকটি স্তূপ দেখলেই তাহাদের আনন্দ হয়।’ Ñব্যাখ্যা করুন।
গ. উদ্দীপকটি ‘পালামৌ’ রচনার কোন বিষয়ের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ? Ñআলোচনা করুন।
ঘ. “উদ্দীপক ও ‘পালামৌ’ রচনার ভূ-প্রকৃতির বর্ণনা এক ও অভিন্ন।” -বিশ্লেষণ করুন।
সৃজনশীল প্রশ্ন-২
চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে অন্যতম মারমা সম্প্রদায়। মারমাদের জীবিকার প্রধানতম উপায় পাহাড়ের গায়ে জুম চাষ করা। এরা উৎসবমুখর জনগোষ্ঠী। বর্ষবরণ উপলক্ষে মারমারা সাংগ্রাই উৎসব পালন করে। সাংগ্রাই উৎসবে গান পরিবেশনের সঙ্গে নৃত্যেরও আয়োজন করা হয়। নৃত্য কখনো দলীয়, কখনো বা একক হয়। নৃত্যের সময় খোল, বাঁশি, করতাল, মৃদঙ্গ প্রভৃতি বাজানো হয়। মারমা জনগোষ্ঠীর সকলেই এই আনন্দ-আয়োজনে অংশগ্রহণ করে।
ক. ‘পরগনা’ কী?
খ. ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ Ñউক্তিটি বুঝিয়ে বলুন।
গ. উদ্দীপকে ‘পালামৌ’ রচনার কোন দিকটি প্রকাশ পেয়েছে? Ñআলোচনা করুন।
ঘ. “মারমা ও কোল উপজাতির সাংস্কৃতিক জীবনধারা একইসূত্রে গাঁথা।” Ñউদ্দীপক ও ‘পালামৌ’ রচনার আলোকে মন্তব্যটি বিচার করুন।
নমুনা উত্তর : সৃজনশীল প্রশ্ন
সৃজনশীল প্রশ্ন-১ এর নমুনা উত্তর:
ক. ‘পালামৌ’ একটি ভ্রমণবিষয়ক স্মৃতিচারণমূলক রচনা।
খ. উক্তিটির মধ্য দিয়ে লেখক তাঁর পাহাড় দেখার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। সমতল অঞ্চলের মানুষ সমতল মাঠ দেখে অভ্যস্ত। আমাদের পাহাড়-পর্বত দেখার সুযোগ তেমন একটা ঘটে না। কেবল উঁচু ঢিবি দেখেই আমরা আনন্দ অনুভব করি। আর পাহাড় দেখার সুযোগ পেলে তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। আলোচ্য রচনাটির লেখকও সমতল অঞ্চলের মানুষ। তাই ‘পালামৌ’ অঞ্চলে ক্ষুদ্র পাহাড় দেখে তিনি আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।
গ. উদ্দীপকটির বিষয়বস্তু ‘পালামৌ’ রচনায় বর্ণিত পাহাড়ি অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রকৃতি মানুষের মনে অপার আনন্দের সঞ্চার করে। এই আনন্দ পাওয়ার জন্য মানুষ ছুটে যায় প্রকৃতির রাজ্যে। পাহাড়ও প্রকৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। পাহাড়ের অনুপম সৌন্দর্য মানুষের নয়ন ও মন দুটোই কেড়ে নেয়। ছোট-বড় নানা রকম পাহাড়ের বর্ণনা উদ্দীপক ও ‘পালামৌ’ রচনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অপরূপ প্রকৃতি উদ্দীপকের রাঙ্গামাটি এবং পালামৌ উভয় অঞ্চলকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। লেখক পালামৌতে গিয়ে সেখানকার পাহাড়-পর্বত দেখে অভিভূত হয়েছেন। সেখানে এত বড় পাহাড় রয়েছে যে নদী, আবাদি জমি, ঘর-বাড়ি কিছুই দূর হতে গোচরে আসে না। তাঁর কাছে সেখানকার পাহাড়গুলোকে বিচলিত নদীর সংখ্যাতীত তরঙ্গ বলে মনে হয়েছে । উদ্দীপকে বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলার পাহাড়ের কথা বলা হয়েছে। সেখানে প্রথমে নিচু পাহাড়, তার পরে উঁচু পাহাড় চোখে পড়ে। এলাকাটি যেন পাহাড়ে পাহাড়ে একাকার হয়ে আছে। পাহাড়ের সারি আকাশ আর মেঘকে দৃষ্টিসীমার বাইরে নিয়ে যায়। পাহাড়ের এই অপূর্ব সমন্বিত অবস্থান ‘পালামৌ’ এবং উদ্দীপকের রাঙামাটি অঞ্চলের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
ঘ. পাহাড়ের সারি ‘পালামৌ’ ও উদ্দীপকের রাঙামাটি অঞ্চলকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে বলে উভয়ের বর্ণনা এক ও অভিন্ন। পাহাড় দেখা আনন্দের শিহরণ জাগায়। উঁচু পাহাড় আর নিচু পাহাড়ের সৌন্দর্য মানুষ প্রাণভরে উপভোগ করে। মেঘের কোলে পাহাড় আর পাহাড়ের কোলে মেঘ এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। মানুষ যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির এই মোহময়তায় মুগ্ধ হয়েছে। উদ্দীপক ও ‘পালামৌ’ রচনায় এমনই এক পাহাড়শ্রেণির উল্লেখ রয়েছে। উদ্দীপকে রাঙামাটি অঞ্চলের পাহাড় সারির বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়েছে। পালামৌতেও দেখা যায় পাহাড়গুলো বিচলিত নদীর মত তরঙ্গায়িত, শুধু স্তূপাকৃতির নয়। কোথাও কোথাও পাহাড়গুলো একশিলা, তবু কত বৃক্ষকে ধারণ করে আছে।
নিয়মিত বৃষ্টিস্নাত হয় না বলেই সেখানকার পাহাড়গুলো পেয়েছে এক বিশেষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পালামৌতে লেখকের চোখে পড়েছিল শাল, কদম্ব প্রভৃতি বৃক্ষ। পালমৌর জঙ্গল অতি দুর্গম, কোথাও তার ছেদ নেই। লেখক সেখানে দেখেছিলেন পর্বত ছায়ায় রম্য অর্ধশুষ্ক একটি ক্ষুদ্র প্রান্ত যেখানে মধু বা মৌয়াবৃক্ষ ব্যতীত আর কিছু নেই, সব জায়গা অতি পরিষ্কার। উদ্দীপকে বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলার মনোলোভা বর্ণনা এবং ‘পালামৌ’-এর নান্দনিক উপস্থাপনা আমাদের কাছে মনে হয় একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পাহাড়শোভিত উভয় অঞ্চলের চিত্রই আমাদের সমভাবে আকৃষ্ট করে। উদ্দীপকে বাংলাদেশের রাঙামাটি অঞ্চলের পাহাড় ও ‘পালামৌ’-এর পাহাড়ের বর্ণনা যেন একসূত্রে গাঁথা।
অ্যাসাইনমেন্ট : নিজে করুন
সৃজনশীল প্রশ্ন :
রাজধানী শহর ঢাকা ছাড়িয়ে শতাধিক কিলোমিটার উত্তরে পুরনো শহর ময়মনসিংহ। এ জেলার গারো পাহাড়ে বাস করে গারো সম্প্রদায়ের লোকেরা। গারোরা মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এরা মাতৃতান্ত্রিক। নারীরা পরিবারের সম্পত্তির মালিক হয়। গারো পরিবারের সন্তান-সন্ততিরা মায়ের পদবি ধারণ করে। এরা নারী-পুরুষ একসাথে মাঠে কাজ করে।
ক. পেনাল কোড কী?
খ. ‘যে বিপদ না বুঝে সেই সাহসী।’ -কেন?
গ. উদ্দীপক ও ‘পালামৌ’ রচনার নারীদের সাদৃশ্যপূর্ণ অংশগুলো তুলে ধরুন।
ঘ. “গারো সম্প্রদায়ের নারীদের চেয়ে কোল নারীরা অধিকতর জীবন সংগ্রামী।” -উদ্দীপক ও ‘পালামৌ’ রচনার আলোকে মন্তব্যটি বিচার করুন।
0 Comments