অর্থনীতির উৎপত্তি ও বিকাশ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। মানুষ যখন পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সম্পদ ব্যবহার করতে শুরু করে, তখনই অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপিত হয়। এর পরবর্তী বিকাশ বিভিন্ন যুগে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঘটে, যা আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তোলে। এখানে অর্থনীতির উৎপত্তি ও বিকাশের প্রধান পর্যায়গুলো আলোচনা করা হলো:
১. অর্থনীতির উৎপত্তি:
অর্থনীতির উৎপত্তি মানবসভ্যতার প্রথম দিকে ঘটে, যখন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন—খাদ্য, আশ্রয় এবং অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল। শুরুতে এটি ছিল খুবই সহজ এবং প্রাথমিক পর্যায়ের এক ধরনের আদান-প্রদান ব্যবস্থা (বার্টার সিস্টেম), যেখানে পণ্য বা সেবা সরাসরি বিনিময় করা হতো। অর্থাৎ, কোন একটি দ্রব্যের মূল্য ছিল অন্য একটি দ্রব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত।
- প্রাথমিক মানব সভ্যতা: শিকার, সংগ্রহ এবং কৃষির মাধ্যমে মানুষের প্রয়োজনীয়তাগুলো পূর্ণ করা হতো। তখন মানুষ নিজেদের জন্য খাবার এবং আশ্রয় ব্যবস্থা তৈরি করত। এই পর্যায়ে অর্থনীতির ভিত্তি ছিল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ।
- কৃষি বিপ্লব: কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে মানব সভ্যতা স্থায়ীভাবে কৃষি উৎপাদন শুরু করে, যা তাদের বসবাসের জায়গা স্থায়ী করে তোলে এবং বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের জন্য সুযোগ তৈরি হয়। কৃষি বিপ্লব অর্থনীতির অগ্রগতির একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।
২. অর্থনীতির বিকাশ:
অর্থনীতি বিকাশের ধারায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যা মানব সমাজে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও কর্মকাণ্ডের জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা হলো:
- শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution):
১৮শ শতাব্দীর শেষ দিকে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে অর্থনীতির কাঠামো এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া মৌলিক পরিবর্তন লাভ করে। যান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যার ফলে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে শ্রম, সম্পদ এবং বাজারের কাঠামোয়। এই বিপ্লবের ফলে বৃহৎ শিল্পায়ন, নগরায়ণ এবং বাণিজ্যিক সংস্থার বিকাশ ঘটে, যা অর্থনীতির একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
- বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার ব্যবস্থা:
শিল্প বিপ্লবের পর, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং বাজার ব্যবস্থা আরও জটিল হয়ে ওঠে। ব্যবসা এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য আইন এবং নীতি তৈরি হতে থাকে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হয়।
- বিশ্বায়ন (Globalization):
বিশ্বায়নের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং তথ্য প্রযুক্তির বিস্তার ঘটায়। দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃনির্ভরতা বৃদ্ধি পায় এবং পণ্য, সেবা, ও বিনিয়োগের সীমান্ত পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
- তথ্য প্রযুক্তি বিপ্লব (Information Technology Revolution):
২০শ শতাব্দীর শেষ দিকে, তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি বিশেষত কম্পিউটার, ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থনীতি আরও জটিল এবং বৈশ্বিক রূপ নেয়। বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্রুত বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়, এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হয়।
- আধুনিক অর্থনীতি:
আধুনিক অর্থনীতির বিকাশে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাজার এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তি এবং তথ্যের উপর ভিত্তি করে ব্যবসা, অর্থনৈতিক মডেল এবং কাজের ধরন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।
উপসংহার:
অর্থনীতির উৎপত্তি ছিল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে, তবে সময়ের সাথে সাথে এর বিকাশ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে হয়েছে। কৃষি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব, বিশ্বায়ন এবং তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব অর্থনীতির কাঠামোকে পাল্টে দিয়েছে এবং এখন এটি একটি বৈশ্বিক এবং জটিল সিস্টেমে পরিণত হয়েছে।
0 Comments