অসীম অভাব (Infinite Scarcity) অর্থনীতির একটি মৌলিক ধারণা, যা মানুষের অগণিত চাহিদা এবং সীমিত সম্পদের মধ্যে সম্পর্ককে বোঝায়। অর্থাৎ, মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন অসীম বা শেষহীন, কিন্তু পৃথিবীতে সেই চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ (যেমন—প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রম, পুঁজি) সীমিত। এই অসীম অভাবই অর্থনীতির মূল সমস্যা সৃষ্টি করে, যা পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে।
অসীম অভাবের ব্যাখ্যা:
1. চাহিদার অসীমতা:
মানুষের চাহিদা এবং প্রয়োজন কোনো দিনও শেষ হয় না। আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলো যেমন—খাদ্য, আশ্রয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং নিরাপত্তা—এসব পূরণ হওয়ার পরেও মানুষের আরও নতুন নতুন চাহিদা তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো মানুষ যখন তার খাদ্য ও বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ পায়, তখন সে তার জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে চায়, অর্থাৎ বিলাসবহুল পণ্য বা সেবা খোঁজে।
2. সম্পদের সীমাবদ্ধতা:
পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সীমিত। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ভূমি, শ্রম, পুঁজি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নেই যা সব মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারে। অর্থনীতি এই সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে চাহিদা পূরণের উপায় বের করার চেষ্টা করে।
অসীম অভাবের প্রভাব:
অসীম অভাবের কারণে অর্থনীতিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এবং প্রভাব দেখা যায়:
1. বিকল্প খরচ (Opportunity Cost):
যখন সীমিত সম্পদ রয়েছে এবং আমরা একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তখন অন্য কোনো সুযোগ বা বিকল্পের মাধ্যমে যা কিছু অর্জন করা যেতো, তা হারানো হয়। অর্থাৎ, যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা একটি বিকল্প খরচ তৈরি করে। এই বিকল্প খরচে কীভাবে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, তা অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
2. সম্পদের কার্যকর ব্যবহার:
সীমিত সম্পদ নিয়ে সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে কাজ করা অর্থনীতির একটি বড় লক্ষ্য। সম্পদের অপচয় রোধ করতে এবং সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করতে অর্থনৈতিক সিস্টেমগুলো পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়। এ কারণে বাজারের মূল্য এবং সরবরাহ-চাহিদার সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
3. অর্থনৈতিক সংকট ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ:
যখন অর্থনীতিতে অসীম অভাব থাকে, তখন সরকার এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সত্ত্বা তাদের সম্পদ কিভাবে বণ্টন করবে এবং কীভাবে উন্নয়ন নিশ্চিত করবে, তা নিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। এই অবস্থায় সরকার অনেক সময় বিভিন্ন নীতি (যেমন—রাজস্ব সংগ্রহ, বাণিজ্য নীতি, মুদ্রানীতি ইত্যাদি) গ্রহণ করে।
4. অর্থনৈতিক বৈষম্য:
সীমিত সম্পদ এবং অসীম চাহিদার কারণে কিছু ব্যক্তির বা শ্রেণীর কাছে অধিক সম্পদ থাকতে পারে, যখন অন্যদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে ধনী ও গরিবের মধ্যে বিশাল পার্থক্য দেখা যায়।
অসীম অভাবের সমাধান:
অর্থনীতির মূল কাজ হলো সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে অসীম চাহিদা পূরণের উপায় বের করা। এর জন্য বিভিন্ন নীতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়:
1. উৎপাদন বৃদ্ধি: প্রযুক্তি, শ্রম দক্ষতা এবং ব্যবস্থাপনা উন্নতির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
2. সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার: সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যাতে সম্পদের অপচয় কমে এবং যথাযথভাবে চাহিদা পূরণ হয়।
3. বিকল্প ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা: বিভিন্ন পরিস্থিতি ও চাহিদার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে সংকটকালীন সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়।
উপসংহার:
অসীম অভাব অর্থনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং মানুষের চাহিদার অসীমতার মধ্যে সঙ্গতিপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে। এটি অর্থনীতির সব সিদ্ধান্ত ও কৌশলের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যেখানে অর্থনৈতিক সংগঠন, সরকারি নীতি এবং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সীমিত সম্পদ ব্যবহারের সর্বোত্তম উপায় খোঁজা হয়।
0 Comments